পড়াশোনায় এআই ব্যবহার: পড়াশোনায় এআই-এর ব্যবহার বাড়ছে, তবে এটি শেখার সুযোগ নষ্ট করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এআইকে শর্টকাট হিসেবে নয়, বরং একটি শেখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। এটি টিউটর বা আইডিয়া জেনারেটর হিসেবে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু মূল চিন্তাভাবনা এবং কাজ অবশ্যই শিক্ষার্থীর হতে হবে। অভিভাবকদের উচিত, সন্তানদের সাথে এআই ব্যবহার নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা এবং এর সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকি সম্পর্কে তাদের সচেতন করা।
স্কুলে এআই ব্যবহার: ঝুঁকি, সুবিধা ও অভিভাবকদের করণীয় সম্পূর্ণ গাইড
প্রযুক্তি এখন আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢুকে পড়েছে। এর সবচেয়ে নতুন ও শক্তিশালী সংযোজন হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। স্কুলশিক্ষার্থীরাও এখন পড়াশোনার কাজে এআই ব্যবহার করছে, যা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আলোচনা ও উদ্বেগ বাড়ছে। একটি জনপ্রিয় আমেরিকান জরিপ অনুসারে, কিশোর-কিশোরীদের একটি বড় অংশ হোমওয়ার্কের জন্য চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করছে। এই প্রবণতা অভিভাবক ও শিক্ষকদের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
এই আর্টিকেলটি শুধুমাত্র এআই ব্যবহারের বিপদ নিয়ে নয়, বরং এটি কীভাবে একটি কার্যকর ও উপকারী টুল হতে পারে, তা নিয়েও একটি পূর্ণাঙ্গ গাইড। আমরা দেখব, কীভাবে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এআই-কে একটি শেখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শেখাতে পারেন, যা তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের জন্য অপরিহার্য।
এআই ব্যবহার: কেন বাড়ছে এবং এর পেছনের ঝুঁকি
শিক্ষার্থীরা এআই ব্যবহার করে দ্রুত বাড়ির কাজ শেষ করতে পারে, যা তাদের কাছে একটি সহজ পদ্ধতি। কিন্তু এর ফলে তারা নিজেদের শেখার সুযোগ হারাচ্ছে। ফেয়ারলেইহ ডিকিনসন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কারা আলাইমোর মতে, এটি এক ধরনের প্রতারণা। যদি এআই সব কাজ করে দেয়, তবে শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্ক একটি পেশির মতো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এতে তাদের বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা কমে যায়।
কমন সেন্স মিডিয়া-এর সিনিয়র ডিরেক্টর রবি টরনি এই বিষয়ে অভিভাবকদের সতর্ক করে বলেন, “নিশ্চিত করুন, শিশুরা এআইকে শেখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, শর্টকাট পদ্ধতি হিসেবে নয়।”
এআই-কে শেখার টিউটর হিসেবে ব্যবহার করার কৌশল
এআইকে যদি সঠিক উপায়ে ব্যবহার করা যায়, তবে এটি শেখার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। অভিভাবকরা শিশুদেরকে এআইকে টিউটর বা শিক্ষকের মতো ব্যবহার করতে শেখাতে পারেন।
- জটিল ধারণার ব্যাখ্যা: যদি কোনো শিক্ষার্থী গণিত বা বিজ্ঞানের কোনো জটিল বিষয়ে আটকে যায়, তবে তারা এআইকে সেই ধারণাটি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করতে বলতে পারে।
- ব্রেনস্টর্মিং ও আইডিয়া জেনারেশন: কোনো প্রজেক্ট বা অ্যাসাইনমেন্টের জন্য এআই থেকে আইডিয়া বা ধারণা নেওয়া যেতে পারে। তবে লেখার কাজ এবং বিশ্লেষণ অবশ্যই শিক্ষার্থীর নিজের হতে হবে।
- অনুশীলনের গুরুত্ব: টরনি জোর দিয়ে বলেন, “আমাদের মস্তিষ্ক পেশির মতো। অনুশীলন ছাড়া দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়।” তাই এআই ব্যবহার করার সময় শিক্ষার্থীদেরকে মূল কাজগুলো নিজেদের করার জন্য উৎসাহিত করা উচিত।
এআইয়ের ‘হ্যালুসিনেশন’ বা ভুল তথ্য: ফ্যাক্ট চেকের গুরুত্ব
এআই চ্যাটবটগুলো মাঝে মাঝে ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়, যাকে ‘হ্যালুসিনেশন’ বলা হয়। এটি এআইয়ের একটি বড় সীমাবদ্ধতা। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষক দেখেছেন যে তার শিক্ষার্থীরা এআই ব্যবহার করে এমন একটি বিষয়ে ভুল তথ্য দিয়েছে যা সম্প্রতি একটি নতুন আইন দ্বারা পরিবর্তিত হয়েছে।
তাই শিশুদেরকে অবশ্যই শেখাতে হবে, এআইয়ের দেওয়া কোনো তথ্যই যাচাই ছাড়া বিশ্বাস করা যাবে না। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে বসে একসাথে তথ্যের সত্যতা যাচাই (ফ্যাক্ট চেক) করতে পারেন। এটি ভবিষ্যতে তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হয়ে উঠবে।
এআই এবং ব্যক্তিগত তথ্য: কেন সতর্ক থাকা জরুরি?
এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির একটি হলো ডেটা প্রাইভেসি। অনেক সময় শিশুরা অসাবধানতাবশত এআই চ্যাটবটে ব্যক্তিগত তথ্য বা ছবি শেয়ার করে, যা ডেটাবেজে সংরক্ষিত হয়ে যায় এবং অন্য ব্যবহারকারীদের কাছে প্রকাশ হতে পারে।
এই ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। আপনার সন্তানের যদি কোনো SaaS tools pricing বা cybersecurity plans সম্পর্কিত জ্ঞান না-ও থাকে, তাকে অন্তত এই সহজ ধারণাটা দিতে হবে যে এআই আপনার বাসার ছবি বা আপনার ব্যক্তিগত কোনো তথ্য জানতে চায় না। আপনার ডিজিটাল ডেটা সুরক্ষিত রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝানো দরকার। শিশুদের বোঝাতে হবে যে এআই কোনো বাস্তব ব্যক্তি বা বন্ধু নয় এবং এটি ব্যক্তিগত পরামর্শ দিতে পারে না। অনলাইন টুলস ও প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার না করার নিয়ম তৈরি করা প্রয়োজন।
পরিবারের জন্য এআই ব্যবহারের নিয়মাবলি
শিশুদের জন্য এআই ব্যবহারের একটি সুস্পষ্ট পারিবারিক নিয়ম তৈরি করা উচিত। এতে এআই-এর অপব্যবহারের ঝুঁকি কমে।
- স্থান নির্ধারণ: এআই ব্যবহারের জন্য একটি নির্দিষ্ট ও খোলা জায়গা বেছে নিন, যেমন – বসার ঘর। শয়নকক্ষে এর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করুন।
- সময়সীমা: এআই-মুক্ত সময় নির্ধারণ করুন, যেমন – খাবার সময় বা ঘুমানোর আগে।
- খোলা আলোচনা: নিয়মিতভাবে শিশুদের সাথে এআই ব্যবহার নিয়ে কথা বলুন। তাদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করুন।
এআই একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, কিন্তু এটি মানুষের চিন্তাভাবনা বা শেখার বিকল্প হতে পারে না। অভিভাবকরা যদি সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকেন, তবে তারা নিশ্চিত করতে পারেন যে এআই একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে, যা শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ বাড়াবে, নষ্ট করবে না।
এআই প্রযুক্তির ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। এটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের উচিত, এর ঝুঁকিগুলো জেনেও এর সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানো। অভিভাবকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে শিশুরা এআই-কে একটি শক্তিশালী শিক্ষামূলক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শিখবে, যা তাদের ভবিষ্যৎকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
আপনার সন্তান কি পড়াশোনায় এআই ব্যবহার করে? এই বিষয়ে আপনার মতামত ও অভিজ্ঞতা আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।
আরও পড়ুন: একাদশ শ্রেণি ভর্তি ফলাফল: ৩৭৮ কলেজ শূন্য, ২৫ হাজার বঞ্চিত! কারণ কী?